মাহবুব সিদ্দিকীর শহর রাজশাহীর আদিপর্ব (২০১৩) গ্রন্থের ৩৬৬-৩৮৫ পৃষ্ঠায় কবি ফজর আলি খাঁনের ‘রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ শিরোনামে একটি পাণ্ডুলিপি প্রকাশ করেন। ফজর আলি খাঁনের জন্ম ১৮৯৫ সালে ও মৃত্যু ১৯৮০ সালে। মাহবুব সিদ্দিকী তাঁর বিএ পাসের সাল উল্লেখ করেছেন ১৯১৪। পাণ্ডুলিপি পড়ে মনে হয় জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অনেক কিছুই তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে তথ্য উপস্থাপন করেছেন। তিনি লিখেছেন,‘.....অনুমান ৭০ বৎসর হইল চলনের জমিদার ভুবন মোহন মৈত্রেয় মালোপাড়ায় যেখানে একটি ডোবা ও গুলির আড্ডা ছিল সেখানে ভুবন মোহন পার্ক স্থাপন করেন। শহরের চাহিদা হিসাবে ইহা অত্যন্ত ছোট হইলেও বর্তমানে ইহাই একমাত্র পার্ক।’
রাজশাহী ভুবন মোহন পার্কের শহীদ মিনার। বেদির উপর স্থাপিত সাতটি স্তম্ভের মধ্যে মাঝের লম্বা স্তম্ভটির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত লিখা হয়েছে রাজশাহীর ভাষা সৈনিকদের নাম (ছবি- ২০১১)
শ্রীকালীনাথ চৌধুরী ১৯০১ সালে প্রকাশিত তার রাজশাহীর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, “বর্ত্তমানে জজ আদালতের একজন প্রসিদ্ধ উকিল বাবু ভুবনমোহন মৈত্র ১৯০০ খৃষ্টাব্দের ১২ই মে হইতে চেয়ারম্যান কার্য্যরে ভার গ্রহণ করিয়াছেন। ভুবন বাবু সহরের (শহরের) এবং জনসাধারণের উপকারের জন্য অনেক অর্থ ব্যয় করিয়াছেন। তিনি রেশম স্কুলে ৩০০০্ মালোপাড়া জুবলী বাগান প্রস্তুত (প্রস্তুতের) জন্য ৩০০০ দান করিয়াছেন”।
রাজশাহী এসোসিয়েশন সাহিত্য পত্রিকা তৃতীয় সংখ্যায় সাইদ উদ্দীন আহমেদ রাজশাহীর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব প্রবন্ধে উল্লেখ করেছেন, ভুবন মোহন পার্কটি সুরেন্দ্র মোহন মৈত্রের পিতা ভুবন মোহন মৈত্রের অনুদানে স্থাপিত।
ঐ সব তথ্য থেকে ধারণা আসে, এখানে রামপুর বোয়ালিয়া মিউনিসিপ্যালিটির অফিস স্থাপন হয়েছিল নিশ্চিতভাবে বলা যায় না। টিনশেডে প্রাথমিক যাত্রা শুরু হলেও জায়গাটি তখন গুরুত্বপূর্ণ ছিলনা। অতপর ১৮৯৭ সালে অক্ষয় কুমারের প্রচেষ্টায় যে সময় ডায়মন্ড জুবিলী ইন্ডাসট্রিয়াল স্কুল প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সে সময়ই হয়তো এ স্থানটিকে জুবিলী গার্ডেন নামে পার্ক বানানোর পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং ভুবন মোহন মৈত্র পৌরসভার চেয়ারম্যান হবার পর তা বাস্তবায়ন হয়।
জুবিলী গার্ডেন নামের পরিবর্তন হয়ে কখন ও কিভাবে ভুবন মোহন পার্ক হলো সে তথ্যও পাওয়া যায় না। ভাষা আন্দোলনের সময় ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি জনসভার জন্য পাক তমদ্দুন মজলিশ রাজশাহী জেলা শাখা যে প্রচারপত্র বিলি করেছিল তাতে স্থানের নাম ভুবন মোহন পার্ক লিখা ছিল। আবার মহানগরীর বেশ কজন প্রবীণ ব্যক্তির নিকট থেকে জানা যায়, পার্কটি গত শতাব্দির চল্লিশ/পঞ্চাশ দশকেও জুবিলী গার্ডেন বা জুবলী বাগান নামে পরিচিত ছিল। এ থেকে ধারণা করা হয় যে, পার্কটির প্রতিষ্ঠাতা ভুবন মোহন মৈত্রর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য ১৯৪৭ সালে পাক-ভারত বিভক্তির আগে বা পরে এর নামকরণ করা হয় ভুবন মোহন পার্ক। তবে নামের পরিবর্তন হলেও এটা অনেক দিন পর্যন্ত জুবলী গার্ডেন নামেই পরিচিত ছিল। ১৯৫৩ সালে এখানে শহীদ মিনার নির্মাণ করে একুশে ফেব্রুয়ারি উদযাপন করা হয়। রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন গত শতাব্দীর ৯০দশকে পার্কটি সংস্কার করে। ভাষা সৈনিক অ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু ১৯৯৮ সালে ১২ডিসেম্বর ভুবন মোহন পার্কের সংস্কারকৃত শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন।
ভাষা সৈনিকদের নাম ফলক স্থাপন: রাজশাহীর ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিকে অমর করে রাখার জন্য রাজশাহী সিটি কর্পোরেশন ভুবনমোহন পার্ক শহীদ মিনারে ২০০৫ সালে ৬৪ জন ভাষা সৈনিকের নাম ফলক স্থাপন করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ তারিখে সকালে ভাষা সৈনিক এ্যাডভোকেট গোলাম আরিফ টিপু এই নাম ফলক উন্মোচন করেন।১৮৮ এ সময় মেয়র মো. মিজানুর রহমান মিনু এম.পি, ৪ জন ভাষা সৈনিক মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী, সাইদ উদ্দিন আহমেদ, আবুল হোসেন, এ্যাভোকেট আব্দুর রাজ্জাকসহ অনেকে উপস্থিত ছিলেন।
নামফলকে স্থাপিত ভাষা সৈনিকদের নামের তালিকা:১৮৯
১. গোলাম রহমান
২. হাবিবুর রহমান
৩. মোহাম্মদ সুলতান
৪. গোলাম তোয়াব
৫. একরামুল হক
৬. আবুল কাসেম চৌধুরী
৭. আতাউর রহমান
৮. আব্দুল লতিফ
৯. এ্যাডভোকেট মাদার বখশ
১০. এ্যাডভোকেট মজিবুর রহমান মিঞা
১১. ক্যাপ্টেন শামসুল হক
১২. ইসাহাক আলী
১৩. আব্দুস সাত্তার মাস্টার
১৪. মো. আলাউদ্দীন
১৫. গোলাম আরিফ টিপু, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
১৬. হাবিবুর রহমান, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
১৭. আবুল কালাম চৌধুরী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
১৮. মহসীন প্রামাণিক, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
১৯. আনসার আলী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২০. আব্দুর রহমান, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২১. এ.এন.এম. ওহিদুল হক দুলু, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২২. আব্বাস আলী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৩. সাইদ উদ্দীন আহমেদ, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৪. মমতাজ উদদীন আহমদ, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৫. মইন উদ্দীন আহম্মদ বোনা, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৬. আবুল হোসেন, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৭. আব্দুল খালেক, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৮. আব্দুর রাজ্জাক খান চৌধুরী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
২৯. জাহানারা বেগম বেনু, ছাত্রী, রাজশাহী কলেজ
৩০. ইয়াসিন আলী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩১. আবুল হোসেন, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩২. আমির হোসেন স্পেন, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৩. জামাল উদ্দীন আহম্মদ, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৪. কামাল উদ্দীন আহম্মদ, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৫. মাসুদুল হক, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৬. লুৎফর রহমান মল্লিক ডলার, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৭. আহম্মদুল্লাহ চৌধুরী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৮. আনোয়ারুল আযীম, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৩৯. আব্দুল হামিদ, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪০. আব্দুল হালিম, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪১. এ.কে.এম. মুসা, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪২. মোশাররফ হোসেন, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪৩. ওয়াজেদ আলী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪৪. খায়রুল আনাম গানু, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪৫. শমসের আলী, ছাত্র, রাজশাহী কলেজ
৪৬. এস.এম.এ. আব্দুল গাফফার, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৪৭. শফিউল আলম, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৪৮. মেসবাহুল হক বাচ্চু, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৪৯. আব্দুল বারী চৌধুরী, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫০. মহাসিনা বেগম, ছাত্রী, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫১. জেরিনা বেগম, ছাত্রী, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫২. কুলসুম বেগম, ছাত্রী, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫৩. আবু সাইদ, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫৪. মাসুদুল হক ডুলু, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫৫. এনামুল হক, ছাত্র, রাজশাহী মেডিকেল স্কুল
৫৬. মনোয়ারা বেগম, ছাত্রী, পি.এন.গালর্স হাই স্কুল
৫৭. হাফিজা বেগম টুকু, ছাত্রী, পি.এন.গালর্স হাই স্কুল
৫৮. হাসিনা বেগম ডলি, ছাত্রী, পি.এন.গালর্স হাই স্কুল
৫৯. রওশন আরা খুকু, ছাত্রী, পি.এন.গালর্স হাই স্কুল
৬০. নাজমুল হক, ছাত্র, কলেজিয়েট স্কুল
৬১. আব্দুর রাজ্জাক, ছাত্র, কলেজিয়েট স্কুল
৬২. মহিউদ্দীন আহম্মেদ, ছাত্র, কলেজিয়েট স্কুল
৬৩. মোশাররফ হোসেন আখুঞ্জী, ছাত্র, লোকনাথ স্কুল
৬৪. গোলাম রাব্বানী, ছাত্র, লোকনাথ স্কুল
২০০৮ সালে এএইচএম খয়রুজ্জামান লিটন মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর পার্কটিকে আবারো সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বর্তমানে সংস্কারের কাজ অব্যাহত আছে। উন্নয়ন কার্যক্রমের আওতায় সুদৃশ্য বাউন্ডারী ওয়াল, বসার গ্যালারি, রেস্টুরেন্ট, কনফারেন্স রুম, ড্রেসিং রুম নির্মাণ করা হবে। এ জন্য ব্যয় নির্ধারণ করা হয়েছে ৫১ লাখ ২০ হাজার টাকা।৫৬০