১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর তদানীন্তন সরকার রেশম শিল্পের জন্য উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ করেনি। কেবলমাত্র কয়েকটি নার্সারী, রেশম ও লাক্ষা শিল্প প্রযুক্তি ইনস্টিটিউট এবং রাজশাহী রেশম কারখানা স্থাপন করা হয়েছিল। মীরগঞ্জ ও বগুড়া বীজাগারের সঙ্গে ১৯৬০-১৯৬১ সালের দিকে একটি পরিকল্পনার মাধ্যমে ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, ঈশ্বরদী, রংপুর, দিনাজপুর, কোনাবাড়ী, ময়নামতি, খাদিমনগর, ভাটিয়ারী ও চন্দ্রঘোনায় দশটি বীজাগার স্থাপনেরব্যবস্থা করা হয়েছিল। রাজশাহীতে প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা করা হয়েছিল একটি রেশম লাক্ষা গবেষণা কেন্দ্র এবং পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে স্থাপন করা হয়েছিল রেশম কারখানা। এ সকল প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম পূর্ণাঙ্গভাবে চালু হওয়ার পূর্বেই ১৯৬১ সালের জুলাই মাসে সকল কার্যক্রম ইপসিকের নিকট হসত্মানত্মর করা হয়। অবকাঠামোগত কিছু সুযোগ-সুবিধা ইপসিকে হস্তান্তর করা হলেও সে সময়ে এ শিল্প পূর্ণাঙ্গভাবে পরিচালনার জন্য তার প্রাপ্ত জনবল ছিল না। যার কারণে ১৯৬১ হতে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত এ শিল্পে নিয়োজিত পেশাজীবীদের উপর তেমন প্রভাব পড়েনি।১৯
বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের প্রধান অফিস রেশম ভবন
রেশম শিল্প বিকাশের মাধ্যমে দারিদ্র্য সীমার নিচে বসবাসকারী গ্রামের লোকদের আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নয়ন ও এ শিল্পের সম্ভাবনাময় দিকগুলো বিবেচনা করে উন্নয়ন ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ১৯৭৭ সালের ৩০ ডিসেম্বর রাষ্ট্রপতির ৬২ নম্বর অধ্যাদেশ জারী করে। রাজশাহীতে এর প্রধান কার্যালয় স্থাপন করে ১৯৭৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে কাজ শুরু করা হয়।১৯ ২০০৭ সালের জুনে বাংলাদেশের রেশম বোর্ড প্রকাশিত তুঁত চাষ ও পলুপালন ম্যানুয়েলের ১৭ পৃষ্ঠায় রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ জারির তারিখ ১৯৭৭ সালের ২৮ ডিসেম্বর ও রেশম বোর্ডের কার্যক্রম শুরুর তারিখ ১৯৭৮ সালের ২ ফেব্রম্নয়ারি উল্লেখ আছে।
রাষ্ট্রপতির ৬২ নম্বর অধ্যাদেশ অনুযায়ী বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের গঠন ছিল নিম্নরূপ:১৯
সার্বক্ষণিক সদস্য
(১) ১ জন চেয়ারম্যান, সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত;
(২) ৩ জন সদস্য, সরকার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত;
খ-কালীন সদস্য
(৩) মহাপরিচালক, বাংলাদেশ পল্লী উন্নয়ন বোর্ড (এক্স অফিসিও);
(৪) পরিচালক, বস্ত্র দপ্তর (এক্স অফিসিও);
(৫) রেশম পোকা পালনকারী (রিয়ারার), রেশম কাটাই (রিলার), রেশম কাপড় বুনন (উইভার) এবং রেশম ব্যবহারকারীদের (ডিলার) মধ্য হতে ১ জন করে সরকার কর্তৃক মনোনীত ৪ জন প্রতিনিধি;
(৬) অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের মধ্য হতে ১ জন প্রতিনিধি।
২০০৩ সালের ২৫ নং আইনানুসারে বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটকে বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের আওতামুক্ত স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হয় এবং বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সরাসরি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসা হয়। ২০১৩ সালের ১৩ নং আইনে আবারো পরিবর্তন আসে। এ আইনে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড, বাংলাদেশ রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং বাংলাদেশ সিল্ক ফাউন্ডেশনকে একীভূত করে বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড প্রতিষ্ঠা করা হয়। এ আইনের সংক্ষিপ্ত শিরোনাম বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড আইন, ২০১৩। ৭ মার্চ ২০১৩ তারিখ বৃহস্পতিবার আইনটি বাংলাদেশ গেজেট আকারে প্রকাশ হয়। এ আইনের ৬নং ধারা অনুসারে বোর্ডের পরিচালনা পর্ষদের গঠন নিম্নরূপ:
ক. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়োজিত মন্ত্রী বা প্রতিমন্ত্রী বোর্ডের চেয়ারম্যান।
খ. জাতীয় সংসদের স্পীকার কর্তৃক মনোনীত একজন সংসদ সদস্য বোর্ডের জ্যেষ্ঠ ভাইস চেয়ারম্যান।
গ. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব বোর্ডের ভাইস চেয়ারম্যান হবেন।
ঘ. রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার- সদস্য।
ঙ. বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত অন্যূন যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা- সদস্য।
চ. অর্থ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত অন্যূন যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা- সদস্য।
ছ. কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত অন্যূন যুগ্ম সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা সদস্য।
জ. শিল্প মন্ত্রণালয় কর্তৃক মনোনীত অন্যূন যুগ্ম-সচিব পদ মর্যাদার একজন কর্মকর্তা- সদস্য।
ঝ. মহা পরিচালক, বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড - সদস্য সচিব।
ঞ. রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক মনোনীত প্রাণীবিদ্যা ও উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ হতে যথাক্রমে একজন করে ২ জন অধ্যাপক। তার মধ্যে একজন মহিলা। সদস্য-২ জন।
ট. সরকার কর্তৃক মনোনীত রেশম পোকা পালনকারী, রেশম উৎপাদনকারী ও রেশম পণ্যের ব্যবসায়ীদের মধ্যে হতে ১জন করে ৩ জন। তার মধ্যে ১ জন মহিলা। কোন গ্রুপের একাধিক মনোনয়ন দেয় যাবে না। সদস্য- ৩ জন।
এ আইনের ১০ নং ধারার ১ উপধারা অনুযায়ী বোর্ডের মহাপরিচালক হবেন যুগ্ম সচিব বা তদূর্ধ্ব পদ মর্যাদা সম্পন্ন কর্মচারী। ২ উপধারা অনুযায়ী তিনি বোর্ডের সার্বক্ষণিক কর্মচারী এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।৫৪৬
২০১৫ সালের ৩১ মার্চ প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী বোর্ডের সম্প্রসারণ নেটওয়ার্ক
বাংলাদেশ রেশম উন্নয়ন বোর্ড এর প্রধান কার্যালয়: রাজশাহী।
রেশম গবেষণা ও প্রশিক্ষণ ইন্সটিটিউট: রাজশাহী। ১টি।
জার্ম পস্নাজম মেইনটেন্যান্স সেন্টার: ২টি- চন্দ্রঘোনা (রাঙামাটি) ও সাকোয়া (পঞ্চগড়)।
আঞ্চলিক রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়: ৫টি- রাজশাহী, রংপুর, ঢাকা, যশোর ও রাঙামাটি।
জেলা রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়: ৭টি- ভোলাহাট, ঠাকুরগাঁ, কুষ্টিয়া, ময়মনসিংহ, বগুড়া, কুমিল্লা, রাজবাড়ী।
রেশম বীজাগার: ১০টি- চাঁপাই নবাবগঞ্জ, ভোলাহাট, মীরগঞ্জ, ঈশ্বরদি, ঝিনাইদহ, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কোনাবাড়ী, ময়নামতি।
তুঁতবাগান: ৭টি- ব্রাহ্মণভিটা, ঠা-িরাম, সাদামহল, রত্নাই, সনকা, রেইচ্যা, রুপসী পাড়া।
গ্রেনেজ: ২টি- ময়মনসিংহ, ভোলাহাট।
পি৩ পলু পালন কেন্দ্র: ১টি- রাজশাহী।
উপজেলা রেশম সম্প্রসারণ কার্যালয়: ৪০টি- বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা সদর।
রেশম সম্প্রসারণ পরিদর্শকের কার্যালয়: ১৬৪ টি- বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম।
চাকী রিয়ারিং সেন্টার : ২৭ টি- বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম।
রেশম পল্লী : ২৩ টি- বিভিন্ন ইউনিয়ন ও গ্রাম।
মিনি ফিলেচার কেন্দ্র : ১২টি- ভোলাহাট (চাঁপাইনবাবগঞ্জ), মীরগঞ্জ (রাজশাহী), দৌলতপুর (কুষ্টিয়া), বাগবাটি (সিরাজগঞ্জ), বড়বাড়ী (লালমনিরহাট), জয়পুরহাট, রাণীসংকৈল (ঠাকুরগাঁ), কোনাবাড়ী (গাজীপুর), ঝিনাইদহ, চাটমোহর (পাবনা), ময়মনসিংহ, লামা (বান্দরবন)।
রেশম কারখানা: ২টি- বর্তমানে সরকারি সিদ্ধান্তে বন্ধ অবস্থায় প্রাইভেটাইজেশন কমিশনে ন্যস্ত আছে।৫৪৭
বাংলাদেশ রেশম বোর্ড কর্তৃক ১৯৯৪ সালে প্রকাশিত তথ্য ও পরিসংখ্যান অনুযায়ী বাংলাদেশ রেশম বোর্ডের অবস্থা ছিল নিম্নরূপ
প্রশাসনিক কার্যক্রম: পাকিস্তান স্বাধীনের পর রেশম চাষ রাজশাহী বিভাগে সীমাবদ্ধ ছিল। ১৯৭৭ সালে রেশম বোর্ড প্রতিষ্ঠার পর রেশম চাষের কাজ উত্তরে ঠাকুরগাঁ জেলা হতে দক্ষিণে সাতক্ষীরা এবং পূর্বে বান্দরবন জেলা পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। দেশের ৩৬টি জেলার ১৯০টি উপজেলায় রেশম চাষ বিস্মৃত।১৯ কার্যক্রমসুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য নিম্ন অফিসসমূহের মাধ্যমে সংযুক্ত সাংগঠনিক কাঠামো পরিচালিত হয়।
প্রধান কার্যালয়: রাজশাহী।
আঞ্চলিক রেশম গবেষণা কেন্দ্র: চন্দ্রঘোনা, পার্বত্য রাঙ্গামাটি জেলা।
সরকারি রেশম কারখানা: ২টি। রাজশাহী ও ঠাকুরগাঁ। সরকারি আদেশে কারখানা ২টি ৩০ নভেম্বর২০০২ তারিখ থেকে বন্ধ।৩১ ও ৩২ রাজশাহীর কারখানাটির লোকসানের পরিমাণ প্রায় একশ কোটি টাকা। কারখানাটি বন্ধের কারণে প্রায় সাড়ে চারশ শ্রমিক-কর্মচারী বেকার হয়ে পড়ে। ২৫০ জন শ্রমিককে কারখানা বন্ধের একমাস পূর্বে ছাঁটাই করা হয়েছিল।১৬৬
সম্প্রসারণ রিজিয়ন: ৫টি। রাজশাহী, ঢাকা, রংপুর, যশোর ও রাঙ্গামাটি।
বিশেষ রেশম সম্প্রসারণ প্রকল্প: রাঙ্গামাটি, পার্বত্য জেলা। [প্রধানমনত্রীর কার্যালয়ের স্পেশাল এফিয়ার্স (কল্যাণ) বিভাগের অর্থানুকূল্যে পার্বত্য রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবন জেলায় রেশম চাষ প্রকল্প]
সম্প্রসারণ জোন: ১১টি। রাজশাহী, ভোলাহাট, রংপুর, ঠাকুরগাঁ, বগুড়া, যশোর, কুষ্টিয়া, ঢাকা, ময়মনসিং, কুমিল্লা ও রাঙ্গামাটি।
রেশম বীজাগার: ৯টি। ভোলাহাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, মীরগঞ্জ, ঈশ্বরদী, বগুড়া, রংপুর, দিনাজপুর, কোনাবাড়ি ও ময়নামতি।
রেশম সম্প্রসারণ কেন্দ্র: ৪২টি। দেশের বিভিন্ন স্থানে।
রেশম সম্প্রসারণ উপকেন্দ্র: ১৬৪টি। দেশের বিভিন্ন স্থানে।
মিনিফিসেলচার: ৯টি। ভোলাহাট, মীরগঞ্জ, দৌলতপুর, সিরাজগঞ্জ, জয়পুরহাট, লালমনিরহাট, রানীসংকৈল, কোনাবাড়ি ও লামা।
ড়্গুদ্র তুঁত বাগান: ৮টি। রত্নাই, সনকা, সাকোয়া, ঠা-িরাম, সাদামহল, ব্রাহ্মভিটা, দারোয়ানি ও রেইচ্যা।
গ্রেনেজ: ২টি। ভোলাহাট ও ময়নামতি।
বিক্রয় ও প্রদর্শনী কেন্দ্র: ৪টি। রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও ঠাকুরগাঁ।
১৯৯২ সালে বাংলাদেশ রেশম বোর্ড প্রকাশিত ‘আর্থিক উন্নয়নে রেশম বোর্ড শিল্প’ গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বিশ্বে ৫৮টি দেশে রেশম উৎপন্ন হয়।১৮ এ তালিকায় বাংলাদেশও অন্তর্ভুক্ত। চীন, ভারত, জাপান, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, ব্রাজিল, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ড উৎপাদনের ক্ষেত্রে অগ্রসর। আর রেশম বস্ত্রের প্রধান ভোক্তা দেশ আমেরিকা, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইটালী, ব্রিটেন, জার্মানী, হংকং, দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান ও ভারত। একমাত্র চীনই কাঁচা রেশম রপ্তানি করে ও ভারত বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তৈরি রেশম বস্ত্র রপ্তানি করে থাকে। ভারত ও থাইল্যান্ড উন্নত রেশম গুটি ও রেশম সুতা উৎপাদনের ক্ষেত্রে সম্প্রতি উন্নতি সাধন করেছে। বাংলাদেশও উন্নত জাতের (শংকর ও দ্বিচক্রী) রেশম কীট পালনের পালনের মাধ্যমে গুণগতমানের রেশম গুটি ও সুতা উৎপাদন বৃদ্ধির প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।১৮
রাজশাহী মহানগরী রেশম শিল্পের সূতিকাগার। রেশম দেশের ঐতিহ্য ও আভিজাত্যের অহংকার। ধনী মানুষের বিলাসী পরিধেয় ও শ্রমজীবী মানুষের রুজির উৎস। বিশ্ব বাজারে রেশম আজও অপ্রতিদ্বন্দ্বী বস্ত্র। রাজশাহী মহানগরী এ শিল্পকে ধরে রেখে উন্নত শৈল্পিক দক্ষতা ও ঐতিহ্যের গৌরব বহন করছে।