বন্ধ সরকারি রেশম কারখানা
রেশম রাজশাহীর ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন শিল্প। এ শিল্পকে কেন্দ্র করেই রাজশাহী মহানগরীর উৎপত্তি। তাই রাজশাহী রেশম শিল্পনগরী নামেও পরিচিত। ইতিহাস থেকে জানা যায়, খ্রিষ্টপূর্ব ৩ হাজার বছর পূর্বে চীনারা রেশম আবিস্কার করে। এ শিল্পকে ব্যাপক উন্নতি করলেও ব্যবসার গোপনীয়তার কারণে তারা পরবর্তী ২ হাজার বছর পর্যন্ত রেশম চাষের গোপনীয়তাকেও সংরক্ষণ করেছিল।১৮ সে সময় তারা কাঁচা রেশম ও রেশম বস্ত্র পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানি করতো। গল্প আছে, এক চীনা রাজকুমারী কাশ্মীরের এক যুবরাজের সঙ্গে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার পর গোপনে মাথার চুলের সঙ্গে জড়িয়ে রেশম পোকার ডিম প্রথমে ভারত উপমহাদেশের কাশ্মীর উপত্যাকায় নিয়ে আসে। পরবর্তীকালে হিমালীয় পাদদেশ হয়ে গঙ্গা অববাহিকায় রেশম চাষ শুরু হয়। খ্রিষ্টপূর্ব ১৪০ এর দিকে রেশম শিল্পের কলাকৌশল চীন হতে তিব্বত ও কাশ্মীর হয়ে ভারতে পাচার হয়।১৯ বাংলাদেশে কখন, কিভাবে রেশম চাষ হয় তা সঠিকভাবে নির্ণয় করা যায় না। তবে বাংলাদেশের রেশম শিল্পের ইতিহাস অবিভক্ত ভারতবর্ষের সূত্রে গাঁথা। মোগল আমলে অবিভক্ত বাংলায় রেশম চাষের ব্যাপক সম্প্রসারণ ঘটে। ঐতিহাসিকদের মতে, মোগল আমলে বেঙ্গল সিল্ক নামে অবিভক্ত বাংলার এ শিল্প ছিল আর্থ-সামাজিক অবস্থানের মাপকাঠি।১৮ অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে বার বার মারাঠা বর্গী আক্রমণের কারণে আত্মরক্ষা উদ্দেশ্যে মুর্শিদাবাদ হতে অনেকে পরিবারসহ পদ্মানদী পার হয়ে রাজশাহীতে বসতি স্থাপন করে। তারা জীবিকার তাগিদে ডাচদের ব্যবসায় শ্রমিক ও কর্মচারী রূপে যোগদান করলে ডাচরা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। ফলে রেশম শিল্প সম্প্রসারণ হতে শুরু করে। পদ্মারতীরে ডাচরাই প্রথমে কুঠি স্থাপন করে। তাদের পর ইংরেজরা রাজশাহী আগমন করে।৪ ইংরেজরা প্রথমে রেশম ও পরে নীল কারখানা নির্মাণ করে। ইংরেজদের ব্যবসা রাজশাহীর আরো শ্রীবৃদ্ধি ঘটায়। তখন শহরবাসী একটি লক্ষণীয় এলাকায় বসবাস করতো। ইউরোপীয় বণিকরা পাকাবাড়ি এবং অন্যান্য নাগরিক আধা পাকা ও কাঁচা বাড়িতে বাস করতো। কেউ কেউ পাকা বাড়িতেও থাকতো। তবে তাদের সংখ্যা ছিল নিতান্তই কম। বণিকরা ব্যবসা-বাণিজ্যে লিপ্ত ছিল। রেশম শিল্প কারিগরেরা নিজ গৃহে রেশম প্রস্তুত করতো। অন্যরা রেশম ও নীল কারখানায় শ্রমিক হিসেবে কাজ করতো। রেশম ও নীল ব্যবসাকে কেন্দ্র করে রাজশাহী হয়ে উঠেছিল সমৃদ্ধ নদী বন্দর। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী হতে ঊনবিংশ শতাব্দী পর্যন্ত রাজশাহী বঙ্গের দ্বিতীয় বন্দর রূপে আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করে।১
বৃহত্তর রাজশাহীতে ছোট বড় বেশ কয়েকটি কারখানা চালু ছিল বলে জানা যায়। এখান থেকে প্রচুর পরিমাণে রেশম ও নীল বিদেশে রপ্তানি হতো। শেষোক্ত সময় হতে ইউরোপীয় বাজারে বিদেশি রেশমের সঙ্গে বাংলার রেশম প্রতিযোগিতায় টিকতে না পেরে এবং ১৮৫৯-১৮৬০ সালে নীল বিদ্রোহ হওয়ার ফলে বাণিজ্যিক শহর হিসেবে রাজশাহীর অবনতি ঘটেছিল। ব্যবসার দিক থেকে রাজশাহীর গুরুত্ব হ্রাস পেলেও শহর পরিত্যক্ত হয়নি। ১৮৮৯ সালে এখানে একটি রেশম ব্যসায়ী কমিটি গঠন হয়েছিল এবং ১৮৯৭/১৮৯৮ সালে একটি রেশম স্কুল চালু হয়েছিল।১৮ স্কুলটির নাম ছিল ডায়মন্ড জুবিলী ইন্ডাস্ট্রিয়াল স্কুল। এর বর্তমান নাম ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড সার্ভে ইনস্টিটিউট, রাজশাহী। ব্রিটিশ সরকারের ঔদাস্য, নীল চাষের ব্যাপকতা, রাজনৈতিক-সামাজিক পট পরিবর্তন ও পেব্রিন নামের এক কোষী পোকার আক্রমণে বিংশ শতাব্দীর শুরু থেকেই এ শিল্প ধ্বংসের মুখে পড়ে।